সরকারি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাস : ছবি - সংগৃহীত |
সরকারি তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম সরকারি কলেজ। এ কলেজে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকে সর্বক্ষণ। তিতুমীর কলেজ পাকিস্তান শাসনামলে পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর নামানুসারে জিন্নাহ কলেজ নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। তিতুমীর কলেজ ঢাকার পুরাতন কলেজের মধ্যে একটি। কলেজটি ঢাকা শহরের বনানী থানার অন্তর্ভূক্ত মহাখালী এলাকায় অবস্থিত।
ইতিহাসের পাতায় তিতুমীর কলেজ
‘জিন্নাহ কলেজ’ নামে ১৯৬৮ সালে সরকারি তিতুমীর কলেজ প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য মহাখালীতে অবস্থিত ডিআইটি খাদ্যগুদাম হিসেবে পরিচিত ভবনে জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রি শাখা স্থানান্তর করেন এবং এর নামকরণ করা হয় জিন্নাহ কলেজ।
$ads={1}
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান রেডিও-টেলিভিশনে এক ভাষণে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহ কলেজ শাখার ছাত্র সংসদের প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) সিরাজউদ্দৌলার নেতৃত্বে টিপু মুনশি ও শাহাবুদ্দিন সহ তৎকালীন কতিপয় ছাত্রনেতা প্রতিক্রিয়া হিসেবে জিন্নাহ্ কলেজের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেন। তখন আনিসুজ্জামান খোকন (জিন্নাহ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক) জিন্নাহ কলেজের নাম ইংরেজ কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে শহীদ হওয়া সৈয়দ মীর নীসার আলি তিতুমীর এর নামানুসারে ‘তিতুমীর কলেজ’ নাম করার প্রস্তাব করেন।
সরকারি তিতুমীর কলেজ মাঠ : ছবি - সংগৃহীত |
২ মার্চ ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় জড়ো হলে সেখানে তৎকালীন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রবের মধ্যস্থতায় জিন্নাহ্ কলেজের নাম ‘তিতুমীর কলেজ’ হিসেবে চূড়ান্ত হয়। ঐ রাতেই ‘তিতুমীর কলেজ’ নামকরণের সাইনবোর্ড লেখা হয় এবং দেয়ালে টাঙিয়ে দেয়া হয়। এলাকার কিছু যুবক তিতুমীর নামকরণের ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করেন।
তিতুমীর কলেজের একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থা
সরকারি তিতুমীর কলেজে শুরুর দিকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত চালু থাকলেও পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার কথা বিবেচনা করে এবং চাহিদা অনুসারে এখন শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিসমূহ চালু রয়েছে। তিতুমীর কলেজে ১৯৭০ সালে প্রথম ইন্টারমিডিয়েট কোর্স চালু করা হয়। যা ১৯৭১ সালের ১৯ মে তে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে অনুমোদন পায়। ১৯৭২ সালের ৩১ মে সর্বপ্রথম অনার্স চালু হয় কলেজটিতে। অনার্স কোর্স চালু হবার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজটি বাংলা এবং রসায়ন বিভাগ চালু করেছিলো।
সরকারি তিতুমীর কলেজ শহীদ মিনার : ছবি - সংগৃহীত |
এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কলেজটিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থাকার সময়ে তিতুমীর কলেজে প্রায় সকল বিভাগ ই চালু ছিল। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পরও পূর্বের সকল কার্যক্রম চালু রয়েছে।
প্রায় ৬০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে এই ক্যাম্পাসে। তাই তো শিক্ষার্থীর সংখ্যায় তিতুমীরকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলা হয়। এত সংখ্যক শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য রয়েছে ২১৫ জনেরও বেশি শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
ক্যাম্পাস সৌন্দর্যের তিতুমীর কলেজ
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস তৈরি হয়েছে ১১ একর এর বিশাল জায়গা নিয়ে। পাঠদানের জন্য কলা ভবন, পুরাতন বিজ্ঞান ভবন, সম্মান ভবন, মাস্টার্স ভবন, নতুন ড. ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান ভবন, শেখ হাসিনা প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবন।
$ads={2}
এছাড়াও এই ১১ একরের এই ক্যাম্পাসে রয়েছে সুবিশাল লাইব্রেরি (পুরাতন বিজ্ঞান ভবনের নিচতলায় অবস্থিত), প্রত্যেক বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা সেমিনার লাইব্রেরি, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পাশাপাশি চিত্র বিনোদনের স্থান হিসেবে আছে সুবিশাল শহিদ বরকত মিলনায়তন।
সরকারি তিতুমীর কলেজ মাঠে শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন : ছবি - সংগৃহীত |
শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাত্র সংসদ (বর্তমানে নির্বাচন না হওয়ায় বন্ধ রয়েছে), খেলাধুলার জন্য আছে বিশাল মাঠ ও জিমন্যাশিয়াম, আছে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফুলের সৌরভে নিজেকে সাজানোর জন্য আছে সুবিশাল শেখ রাসেল পুষ্প কানন, শিশুদের জন্য রয়েছে দিবা যত্ন কেন্দ্র।
সরকারি তিতুমীর কলেজ এর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার : ছবি - সংগৃহীত |
আরও আছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, কেন্দ্রীয় মন্দির, ক্যান্টিন (তোলপাড়), প্রেম ও দ্রোহের কবি রবিন্দ্র –নজরুল মুক্তমঞ্চ সহ বন্ধু –বান্ধব নিয়ে বসে আড্ডা ও খুনসুটি করার জন্য আছে ছাত্রলীগ চত্বর ও শাকিল চত্বর।
তিতুমীর কলেজের বিভাগ ও অনুষদসমূহ
তিতুমীর কলেজে বর্তমানে ৩টি অনুষদের অধীনে ২২টি বিভাগ চালু রয়েছে রয়েছে। তিতুমীর কলেজ এ চালু থাকা অনুষদ ও বিভাগগুলো নিচে দেয়া হলো:
বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো -
- পদার্থবিজ্ঞান
- রসায়ন
- গণিত
- প্রাণিবিজ্ঞান
- উদ্ভিদবিজ্ঞান
- মনোবিজ্ঞান
- পরিসংখ্যান
- ভূগোল ও পরিবেশ
- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি)
সরকারি তিতুমীর কলেজে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন : ছবি - সংগৃহীত |
বাণিজ্য অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো-
- হিসাব বিজ্ঞান
- ব্যবস্থাপনা
- মার্কেটিং
- ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং
কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো হলো -
- বাংলা
- ইংরেজি
- ইতিহাস
- দর্শন
- সমাজবিজ্ঞান
- ইসলাম শিক্ষা
- সমাজকর্ম
- ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
- অর্থনীতি
- রাষ্ট্রবিজ্ঞান
তিতুমীর কলেজের গ্রন্থাগার
প্রতিটি বিভাগের রয়েছে নিজস্ব গ্রন্থাগার বা সেমিনার। কলেজটিতে একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রয়েছে। যেখানে ২০,০০০ এর অধিক বই সংগ্রহে রয়েছে।
তিতুমীর কলেজের পরিবহন ব্যবস্থা
তিতুমীর কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে ৯টি বাস। বাসগুলো হলো -
- BRTC লাল বাস
- সম্পর্ক
- অগ্নিবীণা
- সোনার তরী
- সাদা বাস
- চলন্তিকা
- সৌহার্দ্য
- মতিউর রহমান
- অনিন্দ্যরা
সরকারি তিতুমীর কলেজ এর বাস : ছবি - সংগৃহীত |
তিতুমীর কলেজের ছাত্রাবাস
কলেজটির ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ৫টি আবাসিক হল রয়েছে; এগুলো হলো:
- আক্কাছুর রহমান আঁখি ছাত্রাবাস।
- সুফিয়া কামাল ছাত্রী নিবাস।
- সিরাজ ছাত্রী নিবাস।
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল
- শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল
কীর্তি গাথাদের মেলবন্ধনে তিতুমীর কলেজ
বাংলাদেশের অনেক কীর্তিমান ছাত্র শিক্ষকের মেলবন্ধন ঘটেছে তিতুমীর কলেজে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -
- টিপু মুনশি - বাণিজ্যমন্ত্রী
- রবিউল ইসলাম জীবন - গীতিকার ও সাংবাদিক
- শতাব্দী ওয়াদুদ - অভিনেতা
- হাসান মাসুদ - অভিনেতা
- এম এম শাহীন - সাবেক সংসদ সদস্য, মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া উপজেলা)
- বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ- সাবেক ভিপি ও জিন্নাহ কলেজের সাইনবোর্ড যিনি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন
- জিয়াউল হক পলাশ- অভিনেতা
তিতুমীর কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সফলতা
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও কলেজটির আছে বেশ সফলতা। ২০০৮ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় দক্ষিণ এশিয়ান উৎসব। সেখানে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাছাই করা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেন। সে অনুষ্ঠানে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রবিউল আলম বাবু নাচে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
সরকারি তিতুমীর কলেজ এর বার্ষিক বনভোজন : ছবি - সংগৃহীত |
তিতুমীর কলেজ এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন
তিতুমীর কলেজে অনেকগুলো সক্রিয় সংগঠন আছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো,
- তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতি।
- শুদ্ধস্বর কবিতা মঞ্চ।
- তিতুমীর নাট্যদল
- বির্তক ক্লাব।
- তিতুমীর আইটি সোসাইটি
- ক্লিন এন্ড গ্রিন ক্যাম্পাস
- রোভার স্কাউট
- ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব
- রিসার্চ ক্লাব
- শহিদ তিতুমীর হিউম্যান সোসাইটি
- আদিবাসী সংগঠন
- তিতুমীর আর্ট ক্লাব
- বাঁধন
- বিএনসিসি
- ফটোগ্রাফী ক্লাব
- ক্যারিয়ার ক্লাব
- ক্রাস এন্ড কনফেশন গ্রুপ
সহ নাম না জানা আরও অসংখ্য সংগঠন রয়েছে কলেজটিতে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন